লাউয়ের উপকারিতা : জেনে নিন লাউ খাওয়ার উপকারিতা

লাউ বা কদু এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Lagenaria siceraria। শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে লাউ অন্যতম। লাউ এক প্রকার লতানো উদ্ভিদ যা এর ফলের জন্যে চাষ করা হয়, যা কিনা কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, আর পরিপক্ব অবস্থায় শুকিয়ে এটি বোতল, পাত্র বা নল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এ কারণেই লাউ এর ইংরেজি নাম হয়েছে Bottle gourd। কচি লাউয়ের রং হালকা সবুজ, ভেতরে সাদা রঙের শাঁস হয়ে থাকে। পৃথিবীর অন্যতম পুরনো চাষ হওয়া সবজি হল লাউ।লাউয়ের জন্ম আফ্রিকায়। লাউ একটি ধ্বনি পরিবর্তিত শব্দ, যার মূল শব্দ ‘অলাবু’। লাউকে কোন কোন স্থানে আঞ্চলিক ভাষায় কদু বলে থাকে।

শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে লাউ অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। সবজি হিসাবে সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি লাউ এর মধ্যে রয়েছেন নানান গুণাগুণ। লাউয়ের ভিতরে মজুত রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন সি, বি এবং ডি।
সেই সঙ্গে আরো উপস্থিত রয়েছে ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ফোলেট, আয়রন এবং পটাশিয়াম। যা নানাবিধ রোগের হাত থেকে শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।পুষ্টিগুণে অনন্য সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লাউ। ঝোল,নিরামিষ, ভাজি কিংবা সালাদ হিসেবে এটি খাওয়া যায় ।শুধু লাউ নয়, লাউয়ের খোসা, পাতা সবই খাওয়ার যোগ্য।

লাউ এর পুষ্টি গুন

প্রতি ১০০ গ্রাম লাউ এ আছে-
কার্বোহাইড্রেট – ০.১ গ্রাম
প্রােটিন – ০.৪ গ্রাম
শর্করা – ৪.৬ গ্রাম
জল – ৯২.৬ গ্রাম
খাদ্য আঁশ – ০.৭ গ্রাম
খনিজ উপাদান – ০.৬ গ্রাম
ক্যালসিয়াম – ১০.০ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম – ১০.৪ গ্রাম
ফসফরাস – ১৩৯.০ মিলিগ্রাম
লােহা – ৩০.০ মিলিগ্রাম
সােডিয়াম – ০.৭ মিলিগ্রাম
কপার – ৫.৬ মিলিগ্রাম
সালফার – ১৬.০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন এ – ৮৪ আই. ইউ
তাপশক্তি – ২৫ কিলাে ক্যালােরি

রস করে খান!

রান্না না করে এই সবজিটি রস করেও খাওয়া যায়। লাউয়ের রস বানানো অনেকটাই সহজ। লাউয়ের রস সবাই খেতে পারেন, বিশেষ করে যাঁরা ডায়াবেটিসে ভোগেন তাঁদের জন্য তো লাউয়ের রস খুব উপকারী কারণ এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ কম করে ও রক্তচাপের ভারসাম্য ঠিক রাখে।

কী ভাবে বানাবেন

লাউয়ের খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করে কেটে ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে নিন। এবার এর সঙ্গে একটু গোলমরিচ,পরিমাণ মতো লবণ ও পুদিনা পাতা মিশিয়ে নিন। এর সঙ্গে এক চা চামচ আদাবাটা যোগ করুন। এগুলোর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে খান।

দৈহিক পরিশ্রমের পর লাউয়ের রস খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। কারণ কোনও দৈহিক পরিশ্রমের পর আমাদের শরীরে গ্লুকোস ও কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম হয়ে যায় লাউয়ের রস সেটাকে আবার ঠিক করতে সাহায্য করে। এছাড়া শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট ফেরাতে লাউ সাহায্য করে।

বটল গর্ড ও আদা একসঙ্গে রস করে খেলে শরীরের পেশির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব ও পেশি ভালো থাকে, কারণ এই রসে পটাসিয়াম ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের পেশির পুষ্টি জোগায়। তাই লাউয়ের মরসুমে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার লাউ খাওয়া শরীরের জন্য খুব উপকারি।

লাউয়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা

মানসিক চাপ কমায়

লাউয়ের বেশিরভাগ অংশ পানি দ্বারা পূর্ণ থাকায় শরীরের উপর তার শীতল প্রভাব পড়ে। ফলে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে লাউ।

হজমে সাহায্য করে

লাউয়ে প্রচুর পরিমাণে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় ফাইবার রয়েছে। দ্রবণীয় ফাইবার সহজে খাবার হজম করতে সাহায্য করে এবং হজম সংক্রান্ত সকল সমস্যা সমাধান করে। এছাড়াও নিয়মিত লাউ খেলে অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় হয়। অদ্রবণীয় ফাইবার পাইলসের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।

ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে

আপনি যদি ওজন কমানোর কথা ভেবে থাকেন তাহলে খাবার তালিকায় অবশ্যই লাউ রাখুন। লাউ একটি কম ক্যালোরি সম্পন্ন ডায়েট। লাউয়ের ৯৬% হলো পানি। লাউয়ে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার থাকে এবং খুবই কম ক্যালোরি থাকে বলে তা ওজন কমাতে অত্যন্ত সহায়ক। তাই যারা ওজন কমানোর চিন্তা করছেন তারা বেশি করে লাউ খান। তাহলে শরীরে কম ক্যালোরি যুক্ত হবে এবং পেটও ভরবে।সকালে উঠে এক গ্লাস লাউয়ের রস খেলে পেট ভর্তি থাকে, খিদে নিয়ন্ত্রণে থাকে।

হার্টের জন্য ভালো

লাউয়ে কোলেস্টরলের পরিমাণ শূন্য তাই এটি হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। এই সবজিতে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর পুরনো থাকায় এটি হার্টের জন্য অনেক উপকারী।

প্রস্রাবে বিশৃঙ্খলা রোধ করে

লাউয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি রয়েছে। তাই যাদের প্রস্রাবের জ্বালা পোড়ার সমস্যা আছে কিংবা প্রসাব হলদে হয় তাদের নিয়মিত লাউ খাওয়া উচিত। নিয়মিত লাউ খেলে এ ধরণের সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।

শরীরের গরম

লাউয়ে জলের ভাগ বেশি বলে লাউ খেলে শরীর ঠাণ্ডা থাকে এবং শরীরের গরম কমায়।লাউয়ে প্রায় ৯৬% জল থাকে, যা শরীরের জলের অভাব মেটায়।

লাউ এর অন্তর্নিহিত পুষ্টি

লাউয়ে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে।আয়রন ছাড়াও লাউতে রয়েছে ভিটামিন বি আর সি। এছাড়াও লাউতে সােডিয়াম, পটাসিয়াম ও আরও নানা এসেনসিয়াল মিনারেলস থাকে।

রক্তচাপ ও হৃদরােগ

নিয়মিত লাউ সেবনে রক্তচাপ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তার সাথে সাথে নিয়মিত লাউ সেবনে হৃদরােগ নিয়ন্ত্রণ করে বা হার্ট এটাক এর হাত থেকে রক্ষা করে ।

চুলে অকাল পক্কতা

যাদের অকালে চুল পেকে যাচ্ছে তাঁরা প্রতিদিন সকালে উঠে নিয়মিত একগ্লাস লাউয়ের জুস খেলে চুলে অকাল পক্কতা আসে না।

ইনফেকশন কমাতে

ইউরেনারি ইনফেকশন কমাতে লাউ খুব উপকারী। অর্থাৎ মূত্র জ্বালা করা বা হলুদ হওয়া থেকে প্রটেক্ট করে এই লাউ।

লিভারের সমস্যায়

লিভারের যেকোনো সমস্যায় লাউ খেলে উপকার পাওয়া যায়।

ব্লাড-সুগার

যাদের ব্লাড-সুগার রয়েছে তারা লাউ সিদ্ধ করে লবণ দিয়ে খেলে ব্লাড-সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই যাদের ব্লাড সুগার রয়েছে তাদের দৈনিক খাদ্য তালিকায় লাউ রাখা প্রয়োজন।

শরীরে পানির অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা কমে

শরীরকে চাঙ্গা রাখতে পানির বিকল্প হয় না বললেই চলে।দীর্ঘক্ষণ শরীর তার প্রয়োজনীয় পানি না পেলে দেখা দেয় নানা রকমের রোগ। তাই তো দেহের ভিতরে যাতে পানির ঘাটতি দেখা না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। লাউয়ে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় পানি, যা দেহের ভিতরে পানির অভাব মেটাতে যেমন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যায় কমে।

স্ট্রেস লেভেল কমে চোখের পলকে

লাউয়ে কোলন নামক এক ধরনের নিউরো ট্রান্সমিটার রয়েছে, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রেস লেভেল তো কমেই। সেই সাথে ডিপ্রেশনসহ একাধিক মেন্টাল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকটা কমে যায়। প্রসঙ্গত, গত কয়েক দশকে মানসিক চাপ এবং অ্যাংজাইটির কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।তাই প্রতিদিনের ডায়েটে লাউকে রাখার প্রয়োজনও যে বেড়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কনস্টিপেশন কমায়

অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার কারণে বদ হজম এবং গ্যাস-অম্বল তো বাঙালির নিত্যসঙ্গী। তার উপর কনস্টিপেশনের মতো সমস্যা তো রয়েছেই। এমন পরিস্থিতিতে পেটকে চাঙ্গা করে তুলতে লাউয়ের কোনও বিকল্প হয় না। কারণ এই সবজিটিতে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ফাইবার রয়েছে , যা হজম ক্ষমতার উন্নতি তো ঘটায়ই, সেই সঙ্গে কনস্টিপেশনের মতো রোগের প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ইনসমনিয়ার মতো রোগ দূরে পালায়

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের খাদ্যাভ্যাসের কারণে সিংহভাগ বাঙালিরই ঠিক মতো ঘুম হয় না। ফলের দিনের পর দিন এমনটা হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইনসমনিয়া বা অনিদ্রার মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই আপনিও যদি এমন রোগে আক্রান্ত হতে না চান, তাহলে লাউয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পরেন।কারণ একাধিক গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে, নিয়মিত লাউ খাওয়া শুরু করলে, বিশেষত লাউয়ের রস, অনিদ্রার সমস্যা দূর হয়ে যায়। ফলে বিনিদ্র রাত্রি যাপনের আশঙ্কা আর থাকে না বললেই চলে।যাদের রাতে ঘুম হয় না, তারা লাউয়ের জুসের সঙ্গে তিল তেল মিশিয়ে মাথায় ম্যাসেজ করলে অনেক উপকার পাবেন।

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ে চোখে পরার মতো

লাউয়ে উপস্থিত বিশেষ কিছু উপাদান শরীরে প্রবেশ করে আমাদের ত্বককে ভিতর থেকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে। ফলে সৌন্দর্য তো বাড়েই,সেই সঙ্গে তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই কারণেই প্রতিদিন লাউয়ের রস বা এই সবজিটি দিয়ে তৈরি কোনও না কোনও পদ খাওয়ার পরামর্শ ডাক্তাররা দিয়ে থাকেন। প্রসঙ্গত, লাউ খাওয়া শুরু করলে আরও বেশ কিছু উপকার পাওয়া যায়। যেমন ধরুন মাত্রতিরিক্ত ঘাম হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সেই সঙ্গে ব্রণের মতো ত্বকের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায় ।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়

বেশ কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, প্রতিদিন লাউয়ের রসের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সংক্রমণের পাশপাশি ছোট-বড় নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, ওয়েদার চেঞ্জের সময় লাউয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটা কতটা প্রয়োজনীয়!

লাউয়ের অপকারিতা

১. লাউয়ের রস অত্যধিক তেতো হলে, শরীরে বিষক্রিয়া হতে পারে। ডায়রিয়া, এমনকি বমি বমি ভাব বেড়ে যেতে পারে। সেকারণে খাওয়ার আগে লাউয়ের রস চেখে দেখা জরুরি।
২. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের লাউয়ের রস খেতে নিষেধ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
৩. লাউ খেলে কখনও কখনও অ্যালার্জির সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়,লাউ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী।তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এটি রাখা উচিত।

Leave a Comment